বন্দরনগরী চট্টগ্রামের প্রাণকেন্দ্র হালিশহরের গৌরবময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হালিশহর বেগমজান উচ্চ বিদ্যালয়, যার গর্বিত পথচলায় ৭৭ বছর অতিক্রম করতে চলেছে।এই বিদ্যাপীঠের ভিত্তি স্থাপন করেন তৎকালীন সময়ের খ্যাতিমান শিল্পপতি, শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবক আলহাজ্ব মাবুদ সওদাগর।চট্টগ্রামের হালিশহরের বুকে তাঁর নিজস্ব জমিতে ১৯৪৭ সালে গড়ে ওঠে এই বিদ্যালয়, যা আজ পরিণত হয়েছে এক মহান ঐতিহ্যে। তিনি শুধু এই বিদ্যালয়ই নয়, অসংখ্য মসজিদ, মাদ্রাসা ও জনহিতকর প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে গেছেন যার প্রতিটি চিহ্ন আজও হালিশহরবাসীর গর্ব।
এক সময়ের খ্যাতিমান এই বিদ্যাপীঠে পড়তে আসতেন মহানগরীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা—কেউ হেঁটে, কেউবা সাইকেল চালিয়ে।বিদ্যালয়টি ছিল তখনকার সময়ে চট্টগ্রামের অগ্রণী ও বিখ্যাত স্কুলগুলোর একটি। সেই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালে বিদ্যালয়টি উদযাপন করে এর প্লাটিনাম জুবিলী (৭৫ বছর পূর্তি)—যেখানে প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্রছাত্রীরা রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে অংশগ্রহণ করে এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মেজবান ও আনন্দঘন মিলনমেলার মাধ্যমে।
এই উৎসবে যাঁরা নিরলসভাবে কাজ করেছেন, তাঁদের মধ্যে এক অনন্য ভূমিকা পালন করেন প্রিয় শিক্ষক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন মামুন স্যার। তাঁর আন্তরিক অংশগ্রহণ, নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক দক্ষতায় অনুষ্ঠানটি পেয়েছিল এক বিশেষ মাত্রা—যা প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে গেঁথে থাকবে চিরদিন।
শিক্ষকের বিদায় এক অধ্যায়ের ইতি, এক ভালোবাসার বিস্তার এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের আলোকবর্তিকা ছিলেন আনোয়ার হোসেন মামুন স্যার—যিনি আগামী ৩ জুলাই ২০২৫ তারিখে অবসরে যাচ্ছেন।দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে তিনি বিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন একজন মেধাবী ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে, যার শ্রেণিকক্ষে শিক্ষা ছাপিয়ে যেত হৃদয়ের সংযোগে।প্রমিত উচ্চারণে পাঠদান, দেয়ালিকা কার্যক্রম, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক আয়োজনে নেতৃত্ব, এবং মানবিকতা—সব মিলিয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন একজন শিক্ষকেরও ঊর্ধ্বে।
তিনি কখনো শিক্ষার্থীর আর্থিক দুর্বলতাকে পড়ালেখার পথে বাধা হতে দেননি। নীরবে পাশে দাঁড়িয়ে গড়েছেন মানুষের ভিতরকার বিশ্বাস।তাঁর অসংখ্য ছাত্রছাত্রী আজ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি, বিশ্ববিদ্যালয় ও কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।এক ফেসবুক স্ট্যাটাস—হাজারো হৃদয়ের কান্না ছুঁয়ে যাওয়া মুহূর্ত অবসরের প্রাক্কালে নিজের অনুভূতির কথা তিনি লিখেছেন ফেসবুকে বিদায় প্রিয় ভালোবাসার শিক্ষালয়,হালিশহর বেগমজান উচ্চ বিদ্যালয়। ৩রা জুলাই ২০২৫ আমার শেষ কর্মদিবস। ভাবতেই কেমন আনমনা হয়ে যাই।
দীর্ঘ প্রায় ৩৫ বছরের পথচলা… কত কচিমুখ আজ পরিণত। বর্তমান এবং অতীত মিলে আমার সান্নিধ্যে আসা প্রতিটি ছাত্রছাত্রীদের স্মৃতি ধারণ করেই আগামী জীবন বেঁচে থাকতে চাই।তিনি আরও লিখেছেন—“আমি চেয়েছিলাম নিভৃতে চলে যেতে, কিন্তু তোমাদের ভালোবাসায় আর চুপ থাকা গেল না।”এই পোস্টটি মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে ছাত্রছাত্রীদের টাইমলাইনে।মন্তব্য, স্মৃতিচারণা ও কৃতজ্ঞতাবোধে স্যারের প্রতি ভালোবাসার যে ঢল নেমেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর জন্য অনুপ্রেরণার আলোকবর্তিকা আনোয়ার হোসেন মামুন স্যারের শিক্ষা, নিষ্ঠা, মানবিকতা এবং দায়িত্ববোধ—বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষকের জন্য আদর্শ হয়ে থাকবে।আর প্রতিটি শিক্ষার্থীর কাছে তিনি প্রমাণ করে গেছেন—শিক্ষা মানেই মানবিকতা, দায়িত্ব, এবং আলোর পথে হাঁটার দীক্ষা।
স্যার, আপনি যাচ্ছেন, কিন্তু আপনি থেকে যাচ্ছেন আমাদের হৃদয়ে, আমাদের ইতিহাসে।৭৭ বছরের গৌরবময় হালিশহর বেগমজান উচ্চ বিদ্যালয়ের ইতিহাসে আপনি রয়ে যাবেন এক উজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে।আপনার অবসরকাল হোক প্রশান্তিময়, কল্যাণময় ও প্রার্থনায় পূর্ণ এই প্রার্থনাই রাখছি হাজারো ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকমণ্ডলীর পক্ষ থেকে।